বাবা মা দুজনেরই ব্যস্ততার কারণে ছেলেবেলায় প্রায়ই একা থাকা হত আমায়। ২০০৪ সালের দিকের ঘটনা, খালি বাসায় বন্ধুরা মিলে প্রায়ই আড্ডা দিতে বসা হত একদিন বন্ধুরা বলল কিছু এক্সাইটিং করতে চায়। ওরা একটু মাদক নিয়ে আসল। তখন থেকেই মাঝে মাঝে খাওয়া হত। হোস্টেল এ উঠি এক সময়ে, কড়া শাসন হওয়া সত্ত্বেও সেখানে খাওয়ার পরিমান আরো বেড়ে যায়। স্পেশালি এইচ এস সির পরে। তখন এক বন্ধুর সাথে কিছুদিন থাকি। বিভিন্ন বড় ভাইরা আমাদের বাসায় আসে আর নানা ধরনের মাদক গ্রহন করে, আমিও নিজেকে সামলাতে পারি না।মাঝে মধ্যে আমি নিজ বাসাতেও খেতাম। মা কিছুটা আচ পেলেও বাবা কিছুই জানতো না তার।একদিন বাবা এসে পরেন অফিস থেকে।আমি তখন ৪ঘন্টা যাবত বাথ্রুমে বসে মাদক নিচ্ছিলাম।
বাবা আমাকে জোর করে বের করলে দেখেন পুরো বাথরুম জুড়ে ঘন কুয়াশার মত ধোয়া। বাবা আমার ওপর যত না রাগ করেন তিনি তার চেয়েও বেশি রাগ করেন আমার মায়ের উপরে। মাকে নানা কথা শোনাতে থাকেন, একটি পর্যায়ে বাবা এত এগ্রেসিভ হয়ে যান যা নেশাতুর আমি নিতে পারি না, আমি বাবার মাথায় একটি বন্দুক তাক করে হুমকি দিচ্ছিলাম আর মা পেছন থেকে মারছিলেন আমাকে।আমার বাবা নির্বাক হয়ে যান তখন। কয়েক ঘন্টা পর বাবা আমাকে ডেকে পাঠান বলেন তার ছেলে মৃত, কবর দিয়ে এসেছেন আর আমি যেন বেরিয়ে যাই বাড়ি থেকে। আমি রাগে দুঃখে বেড়িয়ে যাই বাড়ি থেকে, আজ এই দিনে এসে হয়ত বুঝি কতটা কস্ট পেলে একজন বাবা এই কথা বলতে পারেন।আমি বন্ধুদের সাথে উঠি একটি বাড়িতে। সেই বাড়ি যেন আমাকে আরো ভয়াবহ ভাবে মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখতে ৩-৪ প্রকার মাদক তৈরি হচ্ছে, যা সেবন করতে চাই তাই প্রস্তুত। মাদকের জন্য এত এত জায়গায় গিয়েছি হয়ত কখনো টংগী, কখনো নরসিংদী, কখনো ঈশ্বরদী। কিছু মাস চলার পর একটা সময় আসে যখন বাড়িতে ভাতও নেই, কেনার টাকাও নেই।
নিজের শখের জিনিসপত্র বিক্রি করা শুরু করি সবাই। তখন দেখি এভাবে তো আর চলে না, ছোট খাট একটি চক্রের মাঝে তখন জড়িয়ে পরি। এভাবে ৪ বছর কেটে গেলে একদিন আমার মামারা এসে আমায় বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে নিয়ে যান। বিয়ে করি, একটি ফুটফুটে ছেলেও হয়। পেশায় আমি তখন শিক্ষকতা করি। তবে এতকিছুর পরেও আমি মাদককে ছাড়তে পারি না। জীবনের এই পর্যায় এ আসার পরেও মাদক আমাকে এত নিচে নামিয়ে তোলে যে বাবা বাকি পরিশোধ করেন এমন কিছু দোকান থেকে আমি পণ্য কিনে অন্য দোকানে বিক্রি করা শুরু করি টাকার জন্য, একদিন আমি আমার ছোট্ট ছেলের জন্য কিনে আনা দুধের কৌটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে মাদক নেই। এক দিকে এগুলো সহ্য করতেন আমার পরিবার অন্যদিকে আমার উগ্র মেজাজ।এভাবেই দিন যাচ্ছিল, একদিন আমার স্ত্রী আমার ক্লাসের মাঝে ফোন দিয়ে আমাকে বাসায় আসতে বলেন, এসে দেখি আমার জন্য পঞ্চব্যঞ্জন রান্না হয়েছে, অদ্ভুত ভাবে সবাই আমাকে ভীষণ আদর করছে, কিন্তু তাদের সকলের মন ভীষণ খারাপ। সেদিন রাতেই Helping Addict থেকে আমাকে রেস্কিউ করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথম দিন যেদিন কাটাচ্ছিলাম হোমে হুট করে শুনি ওপর থেকে গানবাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে, আমি দৌড়ে উপরে চলে যাই, কি সুন্দর- সুস্থ পরিবেশ। দিন কাটতে থাকে Helping Addict। সব কিছুর স্বাদ যেন বদলে যায়। পানি ভালো লাগে, বাতাস ভালো লাগে, আলো ভালো লাগে আর সবচেয়ে বেশি যা ভালো লাগে তা হল চিন্তা মুক্ত থাকা আমি।
আমার চিন্তা করতে হয় না রোজ সকালে উঠে আজ কোথায় যেতে হবে মাদক কিনতে, কি করতে হবে তার টাকা জোগাড় করার জন্য। আমি আমার পুরো প্রোগ্রামটিতে জীবনের অর্থ খুজে পেয়েছি। আমাদের একটি প্রার্থনা ছিল যার অর্থটা অনেকটা এমন যা বদলাতে পারি তা বদলে ফেলার শক্তি দেও, যা বদলাতে পারার নয় তার চেস্টা থেকে যেন বিরত থাকি। আমি বদলে ফেলি নিজের মাদকাসক্তি কে, আর চেষ্টা করি নিজের জীবনকে না বদলে তা উপভোগ করতে। আমি একমাস আগে প্রোগ্রাম শেষ করে বাহিরের জগিতে পা দিয়েছি। বাবার সাথে আজ আমার সম্পর্ক খুব ভাল। আগের মত খিটখিটে মেজাজে ঝগড়াও হয় না স্ত্রীর সাথে, আর দিনশেষে আমার ছোট ছেলেটাকে আমি নিজের কোলে পাই যার জন্য হয়ত জীবন ও বাজি রাখতে পারব আজ।