তইয়্যুবুর
ছেলেবেলা থেকেই বাবার ভীষণ আদরের আমি।সব কিছুতে সাপোর্ট করতেন বাবা। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল খেলতাম তখন। ‘৯৭ সালের দিকে ক্লাবের খেলার জন্য একবার সিলেটে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই,তখন সেলিব্রেশন এর জন্য এক বোতল করে মাদক সবার জন্য আনা হয়। সেই থেকেই সূচনা, ফুটবলার হিসেবে নাম ডাক থাকায় আর্থিক ভাবে বেগ পেতে হয়নি তেমন। ধীরে ধীরে আমার স্ট্যামিনা কমতে থাকে, একটু দৌড়েই হাপিয়ে উঠি।তখনো বুঝিনি এর পেছনে দায়ী কি। এভাবেই ফেনীতে গিয়ে লেগ ইঞ্জুরি করে বসি। ডাক্তার বলেন খেলার ইতি এখানেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল যেই খেলা নিয়ে আমার এত প্যাশন সেই খেলার মাঠে আমি আর নামতে পারব না এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না আমার। আমার সব ধ্যান ধারণা তখন মাদককে কেন্দ্র করে। কিন্তু তখন তো আর ক্লাবের টাকাও নেই। বাকি পাচ ভাইবোনের থেকে একই সময়ে আলাদা করে গোপনে টাকা চেয়ে নিতাম। এভাবেই চলত।এটা এক সময় জানাজানি হয়ে যায়। টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে যায় আমাকে।
আমি ছোটবেলা থেকেই বেশ কনভিন্সিং। বাবাকে ইউনিভার্সিটি এর ৪ বছরের বেতনের লিস্ট এ বাড়িয়ে বাড়িয়ে টাকা দিয়ে দেই।পরবর্তী ৪ বছর আর কোন চিন্তা হয়নি টাকা নিয়ে। তবে তারমাঝে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠোর হওয়ার জন্য। আমি যেই মাদক গ্রহণ করতাম তা সহজলভ্য ছিল না আর, অন্য মাদকে সরে আসি। বাবারা তখন দেশের বাইরে,বাড়ি ভাড়া সব তুলে নিয়ে এসে তা দিয়েই মাদকের খরচ চালাই। আগারগাঁও এ এক ছুপরি ঘর ৬০০টাকা দিয়ে ভাড়া করে সেখানেই পরে থাকতাম নেশাগ্রস্থ অবস্থায়।বাবা যেদিন দেশে ফিরেন বাবাকে রিসিভ করতে যাওয়া হয়নি ওই ঘরেই পরে ছিলাম।বাবা এসে জানতে চান আমার কথা ভাই বোনের কাছে,কেউই বলতে পারে না।পরে বাবা ডাকলেন আমায়, আমাকে বললেন আমি বাজে কিছু একটা করছি সে জানেন।তবে কি করছি জানতে চান না।আমাকে দিয়ে তার কসম কাটিয়ে নেন যে আমি আর তাতে হাত দিব না।বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতাম আমি, বাবার গায়ে হাত রেখে মিথ্যা তো বলব না।কিন্তু ছেড়ে দিতেও পারছিলাম না, সম্পূর্ণ নতুন আরেক মাদকে এবার সুইচ করি।
কিন্তু এবার ইঞ্জেকশন থেকে গায়ে ছোপ ছোপ দাগ হয়ে যায়।২০০৩ সাল তখন।বাবা আবার ডাকেন আমাকে,এবার ৬ ভাই বোন সকলকে। বাবা সবাইকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কি করা যায় আমাকে নিয়ে।সবার উত্তর একটাই, লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়া হোক। বাবার নয়নের মণি ছিলাম, সে তা মানতে পারছিল না।উঠে চলে যান নিজ ঘরে, ফেরত আসেন হাতে একটি ২০ লাখ টাকার চেক নিয়ে।বলেন ব্যাবসা করতে, নিজেকে ব্যস্ত রাখতে তবে মাদককে ছেড়ে দিতে। আমি ব্যাবসা করি ঠিকই, কিন্তু কিছু টাকা আলাদা করে রাখি মাদক যাতে অটল থাকে আমার জীবনে। আমি একজন লোক হায়ার করি মাসপ্রতি ১৫ হাজার টাকার বেতনে যার কাজ হল আমার শরীরে মাদক ইঞ্জেক্ট করা। এভাবে ৩ বছরে ব্যাবসা উচ্ছনে, সব টাকাও শেষ।বাবার কাছে যাই। বাবা এবার বুকে পাথর রেখেই আমাকে সিঙগাপুর পাঠিয়ে দেন। ২৮ দিন আমি সেই দেশের বিভিন্ন রাস্তায় বিয়ার খেয়ে পরে থাকতাম।আর না পেরে বাবাকে আবার কল দেই, আমি সুস্থ আমাকে নিয়ে আসো। বাবা আমাকে নিয়ে আসেন।
বাবার পছন্দে, লোকের উপদেশে একটা বিয়েও করি দেশে এসে। আমার স্ত্রী খুব ভালো একজন শক্ত মেরুদন্ডের মানুষ, মাদকাসক্ত আমি তার আত্মসম্মানে এভাবে আঘাত করি, উনি আমাকে ছেড়ে চলে যান। ফ্যামিলি থেকে এবার যোগাযোগ পুরো বিচ্ছিন্ন। বিভিন্ন বড় বড় চক্রের মাঝে জড়িয়ে যাই তখন। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল বাবা মারা যান, আমি এতটা নেশায় আসক্ত তখন আমি বাবার লাশ দেখতে যাইনি একটি বারও।বাবা মারা যাওয়ার পরের দিন মাকে ফোন দিয়ে দেড় লাখ টাকা জোর করে নিয়েছি যে স্মৃতিও আমার নেই।২০১৮ সালে আমি বহুদিন কক্সবাজারে থাকার পর ঢাকার বাসায় আসি।কলিং বেল বাজে কিছক্ষণ পর, দরজা খুললে আমাকে ‘Helping Addict’ এর কয়েকজন রেস্কিউ করেন আমার মায়ের কথায়।
৪মাসের প্রোগ্রামে ছিলাম। কোন ইচ্ছা ছিল না মাদক ছাড়ার। আমি বেড়োনোর পর আবার রিল্যাপ্স করি। আবার আমাকেHelping Addict এ আনা হয়,আমার ভাই নিয়ে আসেন।ভাইকে হুমকি দিয়েছিলাম সেদিন, তার চাকরি কেড়ে নিব, ধ্বংস করে দিব। আমার ভাই আমাকে একটি কথাই বলেছিলেন “তুই আমাকে ধ্বংস করতে চাইলে তাই করিস, নিজেকে আর ধ্বংস করিস না।৪ মাস থাক এখানে” এবারো আমি একই চিন্তায় দিন গুনি।যেদিন বেরোব সেদিন ভাই আমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসেন আমাকে নিতে। বলেন ” যাবি তো নেশা করতেই, আগে একটু দেখে নে ছেলে মেয়ে গুলারে। আবার কবে না কবে সুযোগ পাস।” আড়াই বছর পর দেখি ওদের, ওরা আমাকে ঠিকমতো চিনতে পারে না। বাবা এবং স্ত্রী এর এবার সন্তানদের হারাচ্ছি যার জন্য আমি নিজেকে এবং কেবলই নিজেকে দায়ী করতে পারি।একজন বাবা হিসেবে আমি আর মাদক নিতে যেতে পারিনি। কিন্তু আমি তো কিছুই শিখি নি, শিখতে চাইনি পূর্বের চার মাস।
আমি এবার বাসায় এসে কেবল রাতেই থাকতাম সারাদিন আমার স্থান ছিল Helping Addict।কাউন্সিলিং সেশনে বসে যেতাম।সকল কাউন্সিলর এর কাছে যেতাম সেদিন ওটা বলেছিলেন আমি বুঝিনি আবার বলবেন? তারা খুশি মনে আবার বোঝাতো। যা ওভারলুক করেছি তা সব শিখতে হবে আমায় এখন। জীবনে যা মিস করেছি সব আমি ফিরে পেতে চাই।” Helping Addict” থেকে আমি ৪মাসের প্রোগ্রাম থেকে যা পেয়েছি তার পরবর্তী সাড়ে চার বছরে তার চেয়ে বহুগুণ নিয়েছি। এরা আমায় এভাবে আপন করে নিয়েছে। আজ ভালো আছি আমি আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে, কিছু না পাওয়া তো আর ফিরে আসে না,তবে জীবনে এখন যা আছে তা নিয়েও আমি কৃতজ্ঞ।