নোমান
একটু ফাকিবাজ ছিলাম পড়াশোনায়,তখন এইটে পরি, সেই বছর স্কুলে যাইনি বললেই চলে।প্রায় প্রতিদিনই বাংক করতাম,পরীক্ষাও দেয়া হয়নি। নানা রেজাল্ট আনতে গিয়ে এই খবর জানেন।আমার বাবা তখন প্রবাসী,বাবা মা আলোচনা করে আমাকে হোস্টেল এ পাঠিয়ে দেন কিন্তু হোস্টেল এ উঠে আমার সিগারেট এর দিকে ঝোক বেড়ে যায়। এস এস সি পরীক্ষার সময় সেই হোস্টেলেই প্রথম বারের মত মাদক গ্রহণ করি। ধীরে ধীরে পরীক্ষাভিত্তিক ভাবে অনেক ধরনের নেশাদ্রব্যই নেয়া হয় শরীরে। কোন কিছুতে ততদিনেও আসক্ত হইনি। কিন্তু একটা সময় আমরা ৬ জন বন্ধু নিয়ে এক নতুন নেশাদ্রব্য ট্রাই করি।কিন্তু ছোট সে পরিমান আমাদের ওপর তেমন কোন প্রভাবই ফেলেনি। ২দিন পরপর একই ঘটনা ঘটে, ভালো না লাগায় আর খাই নি। একদিন এক কাজিন আমার বাসায় আসে, তার নিজের বাসায় গেস্ট আসে বলে। সে কোক, চানাচুর, আইসক্রিম নিয়ে এসে বেশ আয়োজন করে বসে সেইদিনের সেই মাদকটি নিয়েই।
জোরাজোরি করার কারণে আমি তার সাথে আবার সেই মাদকটি ট্রাই করি। কিন্তু এবারের এক্সপেরিয়েন্স পুরো আলাদা ছিল,এত এনার্জেটিক। আমি আসক্ত হয়ে পরি পুরোপুরি। কিন্তু আমি তো স্টুডেন্ট ছিলাম, অপরদিকে বেশ টাকার প্রয়োজন হয়। এই নেশা আমাকে এত নিচে নামিয়ে দেয় যা কল্পনার বাইরে।তখন ২০০৮ সাল। আমি অনলাইনে কিছু ফেক আইডি খুলি যার প্রত্যেকটিতে ৩ থেকে ৪ হাজার ছেলে ফ্রেন্ড ছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে ৪/৫ জন ছেলে দেখা করতে আসত আমরা বন্ধুরা মিলে তাদের ছিনতাই করে সব রেখে দিতাম।পরে সেগুলো বিক্রি করে ২/১ দিনের মাদকের টাকা যোগার হত। আমি আমার মায়ের বিয়ের গয়না টা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলাম। আরেকবার আমাদের বাসায় আসা দুধওয়ালার সাইকেল চুরি করে আমরা ৫০০টাকা পাই তা দিয়েই সেদিনের টাকা জোগাড় হয়।
আমার বাবা প্রবাস থেকে প্রায় ১২ বছর পরে বাংলাদেশে আসেন।তিনি এসে লক্ষ্য করেন আমার ভাঙা স্বাস্থ্য, চলন বলনের পরিবর্তন। বাবা বুঝে যান।বাবা কাদতে কাদতে আমাকে বলেন ছেড়ে দিতে, আমিও কথা দেই যে ছেড়ে দিব। বাবাকে বলি “১০০০ টাকা দেও, ডিলার এর থেকে বাকি নিয়ে এসেছিলাম।না দিতে পারলে আমাকে ছাড়বে না।” বাবা টাকাটা দিয়ে দেন। আমি সেই টাকাটা নিয়ে ডিলারের কাছেই যাই। কিন্তু টাকা দিতে না, নতুন করে কিনে আবার খেতে। আমি খাওয়া থামাই না। বাবা আস্তে আস্তে টের পেয়ে যায়।বাবা আমাকে ডাকেন, আমি তখন এভাবেই বেশ এগ্রেসিভ মাদকের জন্য, আমাদের কথা একসময় তর্কে বদলে যায় আর তর্ক থেকে একটা সময় আমি বাবার গায়ে হাত তুলে ফেলি। বাবা দমে যান। পরের দিন ই আমাকে “Helping Addict” থেকে রেস্কিউ করে নিয়ে আসা হয়। তখন Helping Addict টিসি প্রোগ্রাম চলে। টিসি প্রোগ্রাম হল থেরাপিউটিক প্রোগ্রাম। আমি ছিলাম প্রোগ্রামের সবচেয়ে ছোট মানুষ।
টিসি প্রোগ্রাম এখনকার মত ফিজিও সাইকোলজিক্যাল থেরাপির মত সহনশীল ছিল না।না না রকম শাস্তি ছিল। ঘুমাতে দিবে না,সিগারেট কেড়ে নিবে, রাতের বেলা গোসল করতে বলবে এমন। এমনই একবার আমাকে শাস্তি দেয়া হয়, আমার বাথরুম পরিস্কার করতে করতে সেদিন জ্বর এসে পরেছিল। সেদিনই ঠিক করেছিলাম মাদকে আর হাত দেব না, আমি এই ধরনের পরিস্থিতিতে আর কোনদিন নিজেকে দেখতে চাই না। “Helping Addict” এ থাকা অবস্থায় থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে আমাদের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় রাত এ, অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিল। বড় হওয়ার পর প্রথম বার কোন সেলিব্রেশন হচ্ছে মাদক ছাড়া। সুস্থ থেকেও যে এভাবে ইঞ্জয় করা যায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ইদের কথা যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আমি বলব “Helping Addict” এর কাটানো ইদ।
মাদকমুক্ত হওয়ার পর থেকে পানি খেতেও যেন ভালো লাগে, পানির স্বাদ ও বদলে গিয়েছে। ইদের খাবার তো অকল্পনীয় লেগেছিল। হোম থেকে বেরোনোর পর সবকিছু যেন নতুন চোখে দেখতে পাই। পরিবার এত ভালোবেসে বরণ করে নেয় আমাকে।আমি আগে যেসব সেলিব্রেশনে যেতাম, আজও যাই। কিন্তু সুস্থ ভাবে ইঞ্জয় করা হয় এখন। ২০১৩ সালে আমি সিগারেট ছেড়ে দেই, যা ছিল একেবারে আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। আমার অবসর সময়,ধ্যান, জ্ঞান সব দেয়ার জন্য আমি নতুন প্যাশন খুজে পাই।এক্সারসাইজ।ট্রেইনার হিসেবে আছি, আমি নিজেও এখন বেশ ফিট। মায়ের যে গয়না টা বিক্রি করে দিয়েছিলাম ঠিক তেমনটা তো দিতে পারিনি তবে দিয়েছি যা পারি।সামর্থ্য হলে ইনশাআল্লাহ অমনটাই দিব।আজ আমি আসলেই বলতে পারি আমার পরিবার, “Helping Addict” আমাকে নিয়ে গর্বিত।