তোমার ছোট বেলার কোন ঘটনা আমাকে বলতে পার?
আমি লিবিয়া থেকে পরিবারসহ বাংলাদেশে চলে আসি, তা বেশ ছোট বেলাতেই। এখানে এসে বেশ বিপদ হল, আমার কারোর সাথে ভাষা মিলত না।তাই ভাবের দেয়া নেয়াও হত না। স্কুলে রীতিমত আমাকে বুলি করত। বাড়িতেও কঠোর নিয়মের চাপ ছিল।ভীষণ এন্টিসোশ্যাল হয়ে যেতে থাকি,প্রায় সবসময়ই নার্ভাসনেস কাজ করত। এতেই দিনে দিনে আমিকে হীনমন্যতা কাছে টেনে নিতে থাকে।
তোমার কারও সাথে কথা হতোনা?
আমার কেন যেন মনে হয়,আমার একমাত্র বন্ধু আমার সৃষ্টিকর্তা। কিভাবে যেন ছোটবেলা থেকেই গডের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে। রোজ রাতেই তার সাথে আমার কথা হত, জানি এ কথা শুনলে সবাই হাসবনা?
এভাবে আরও কি কি হয়?
এত ফ্রাস্টেশন এর মাঝে আমাকে শেষ ধাক্কাটা দেয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়। পরিবারের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে একটা সেমিস্টার ড্রপ হয়, তারা মুখের ওপর বলে দেন “টাকা না থাকলে এই ভার্সিটিতে কি?” আমি বিষয়টা ভেবে আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়েছিল। আমি সবসময়ই শান্তি খোজার চেষ্টা করি। সবকিছু থাকার পরেও কিছু একটা নেই এই অনুভূতি টা তৈরি হয়।ধীরে ধীরে আমার মনে হয় আমি শান্তি পাই,এতদিন যেই শান্তি খুজছিলাম তাই যেন নিজে এসে আমাকে হাতছানি দেয়।
শান্তি আর কখনই পেলেনা?
আমি দেখতে পারতাম আমার এক কাজিন নেশাজাত দ্রব্য নিত। আমাকেও অনেকবার সাধত তার সাথে নেশা করার জন্য। ২০০৯ সালে ভার্সিটির ঘটনাটি ঘটার পর কাজিনের থেকে সেই প্রথম টান। তখন মনে হল এতদিন যে শান্তি খুজেছিলাম এই তো সেই শান্তি।
বেশ কিছুদিন নেশা করতে করতে আমার শান্তি যেন আবার কমতে থাকে।আমি শান্তির জন্য আরো বেশি নেশা করতে থাকি।একটা পর্যায়ে আমার মনে হতে থাকে নেশা ছাড়া আমার জীবনে অবশিষ্ট আর কিছু নেই।তখন আমি বুঝতে পারি আমার জীবন জুড়ে একটা বড় সম্পদ আমি হারিয়েছি।ছোট বেলা থেকেই যখন মানুষের কথা আমি বুঝতাম না সুর আমাকে খুব টানতো যার থেকে আমি গান গাওয়া শুরু করেছিলাম এবং আমার গানের জনপ্রিয়তার কারণেই অনেক মানুষ আমাকে ফ্রিতে নেশা করাতো। কিন্তু একটা পর্যায়ে গানও যেন আমার জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছিল। আমার গডের সাথে আমার আর কথা হত না। তখন আমার অবচেতন মনে আমার ভেতরের ডিম্যানের সাথে আমার কথা হত, সে আমাকে বোঝাতো আমি ঠিকই আছি।আমিও লোকের সাথে তর্ক করতাম মাদকের উপকারিতা নিয়ে।আমি যুক্তি দিতাম মাদকের হয়ে।
আমি এত মাদক নিতে থাকি যে চাহিদা মেটানোর জন্য মোটা অংকের টাকার প্রয়োজন হচ্ছিল।তখন আমার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল,নিজের অফিস থেকে সাপ্তাহিক ৫০ হাজার টাকার মত লাভ হত, কিছুই হাতে থাকত না মাদক কেনার পরে, অফিস ভাড়াটাও দিতে পারতাম না মাস শেষে, উল্টো ফ্যামিলি থেকে টাকা নিতাম। ছোটবেলা থেকে বন্ধু বানাতে সমস্যা হলেও মাদকের টানে নেশাগ্রস্থ কিছু বন্ধু-বড় ভাই দের সাথে বড় সার্কেল গড়ে উঠে। যেই সার্কেল কেবলই প্রয়োজন মেটাতে গড়ে ওঠা তা তো কোন না কোন দিন দুঃসময় বয়ে আনবেই তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম একদিন।এমন একটা দিন আসল যখন আমার নিজের বন্ধুবান্ধবরাই আমাকে মিথ্যা বলে আমার একটা দামি ল্যাপটপ নিয়ে যায়,যা বিক্রি করে মাদক কিনে আনে এবং আমাকেও তার ভাগ দেয়।
আমি আমার নানা বাড়ির গর্ব ছিলাম, সেসময় নানা বাড়ি যাওয়ার পরে আমার মামা আমাকে আলাদা করে নিয়ে যেয়ে বলেন, “তুই আর আসিস না রে এই বাসায়”।তখন বুঝি হয়ত থামানো উচিত এবার। কিন্তু বললেই তো আর করা যায় না। একটা মাদক ছাড়তে গিয়ে আমি অন্য মাদকে আসক্ত হয়ে পরি। এতদিন মনে হত সমস্যাটা হয়ত নির্দিষ্ট একটা মাদকে পরে বুঝতে পারি, সমস্যা আমার নিজের মাঝেই।
আর পরিবারের সবাই মেনে নিল তোমাকে?
লকডাউন এর সময় তখন আমি বাসায় বন্দি। শরীরে উইথড্রয়াল সিন্ড্রোম। পরিবারের ওপর টাকার জন্য মানসিক অত্যাচার চালাচ্ছিলাম। আমি হারে হারে টের পাই, মাদক কত বড় অভিশাপ। শুধু নিজের শরীরের উপর না, আমার স্বপ্ন গুলার উপর, আমার পরিবারের উপর।
একদিন ভীষণ চিৎকার চেচামেচি, ভাংচুর করি বাসায়।
তারও পরে পরিবারের মানুষ কিছুই বলেনি?
পরের দিন বাবা আমাকে একটা জায়গায় ডাকে , বলেছিলেন নতুন ল্যাপটপ কিনে দেবেন। সেখান থেকে আমাকে Helping Addict এ নিয়ে আসা হয়।আমার মনে আছে আমি আসার সময় বাবার একটা শান্ত চেহারা দেখেছি যা আমাকে আশ্বস্ত করেছিল আমি নিরাপদ কোন জায়গায় যাচ্ছি।
আসলে কেমন ছিল?
প্রথম প্রথম খুব মনে হত কবে বাড়ি যাব, জানতে চাইতাম সবার কাছে,আর কতদিন বাকি? সময়ের হিসাব টা ছেড়ে দেই দিনখানেক পরে।কার কাছে করব মিথ্যা অভিনয়? পরিবার?Helping Addict?তারা তো চেনে আমাকে।তবে,Helping Addict এ আসার পর জীবনে প্রথমবার নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণী বলে মনে হয় নি, কেউ বাকা চোখে তাকায়নি। নিজের মত করে বাচতে শিখি এখানে এসেই। নিজের মত গান, কবিতা,গল্প কত কিছু না করেছি।সব কাউন্সিলিং সেশন ই টাইমলি এটেন্ড করতাম।কাউন্সিলিং সেশন গুলো আমাকে বোঝালো আমার কিছু রোগ আছে যা আমার সমস্যা। সেল্ফ ইনভেন্টরি টার উপর ভালোভাবে জোর দেই।সকল ছোট খাট নিয়ম যা পালন করা হয়ত বাধ্যতামূলক নয়,আমি করতাম। যত খারাপ লাগুক নিজের,বোরিং লাগুক করতাম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ হয় Helping Addict এ থেকে। বড় বড় জায়গায় গান গাওয়ার সুযোগ হওয়ার। যাদের আমি আইডল ভাবতাম ছেলেবেলা থেকে তাদের অনেকেই আজ আমাকে চিনে। সত্যি বলত কাউন্সিলিং এ যতটা না সাহায্য পেয়েছি,তার চেয়ে বহু গুণে নিজেকে চিনতে জানতে পেরেছি এই গানের জন্য হোম থেকে এক ভাই যখন আমাকে নিয়ে যেতেন তখন গাড়িতে বসে তার সাথে কথা বলে।
এখন কেমন যাচ্ছে তোমার দিন?
৪ মাস পর আমি বাড়ি ফিরি। অনেস্টি, সেল্ফ কন্ট্রোল এবং বহু কিছুর ভীরে হারিয়ে যাওয়া নিজের সত্ত্বাকে নিয়ে।আজ আমি ১বছর ৫ মাস ধরে মাদকমুক্ত আছি। এখন আমার গড কে আমি আবার নিজের মাঝে ফিরে পেয়েছি।Helping Addict থেকে নিজেকে চেনা শুরু করেছিলাম,ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আজ আমি বেচে থাকি শুধু আজকের জন্য।
আমি একটা সময় কল্পনা করতে পারতাম না আমি নেশা ছাড়তে পারব আর আমার স্বপ্ন গুলো এত দ্রুত পূরণ হবে।